Ramayan Written by Lady Poet : Chandravati Ramayan চন্দ্রাবতী এবং প্রথম মহিলা কবির লেখা বাংলা রামায়ণ "চন্দ্রাবতী রামায়ণ"

 চন্দ্রাবতীর জীবনীঃঃ

 “ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়/ বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়।। ভট্টাচার্য্য বংশে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী/ বাঁশের পাল্লায় তাল-পাতার ছাউনী।। বাড়াতে দারিদ্র-জ্বালা কষ্টের কাহিনী/ তার ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী।। সদাই মনসা-পদ পূজি ভক্তিভরে/ চাল-কড়ি কিছু পাই মনসার বরে।। শিব-শিবা বন্দি গাই ফুলেশ্বরী নদী/ যার জলে তৃষ্ণা দূর করি নিরবধি।। বিধিমতে প্রণাম করি সকলের পায়/ পিতার আদেশে চন্দ্রা রামায়ণ গায়।।” স্বরচিত রামায়ণের ভূমিকায় চন্দ্রাবতী  নিজের আত্মপরিচয় দিয়েছেন এভাবেই। কাব্যের কথা নয়। চন্দ্রাবতী আসলেই অভাগিনী। তার জীবনে যে বেদনাবিধুরতা এসেছে, যে সকরুণতা এসেছে, তা খুব কম মানুষের জীবনেই এসে থাকে। অত্যন্ত করুণভাবে তরুণ বয়সেই সমাপ্তি ঘটেছে এই কবির জীবনের। নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ করুণ জীবনের কারণে পালা রচয়িতা থেকে নিজেই হয়ে উঠেছেন পালাগানের করুণরসে সিক্ত শোকাচ্ছাদিত নায়িকা।

চন্দ্রাবতী মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে অন্যতম এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি নারী কবি৷ এই বিদূষী নারী অন্যান্য কাব্য ছাড়াও পিতার আদেশে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন। তার নিবাস ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত পাঠবাড়ী বা পাতুয়ারী গ্রামে। তাঁর পিতা মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা বংশীদাস ভট্টাচার্য এবং মাতার নাম সুলোচনা। চন্দ্রাবতী অজস্র লোকগীতি রচনা করেন। নৌকার মাঝির কণ্ঠে, ব্রতে, বিয়েতে এবং প্রতিদিনের গার্হস্থ্য জীবনে আজও শোনা যায় চন্দ্রাবতীর গান। ষোল শতকের সামাজিক-আর্থনীতিক অবস্থার স্বরূপ প্রতিফলিত হয়েছে তার রচনায়। চন্দ্রাবতীর স্মৃতি, রচনা, জীবন ও সাহিত্য আজও বহমান স্রোতোধারার মতো গবেষক ও পর্যটককে আকর্ষণ করে।

চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্যগুলি হলো-মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা (মনসার ভাসান, রচনাকাল: ১৫৭৫ শকাব্দ), রামায়ণ। ড. দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। লৌকিক মানবিক ও কিছু মৌলিক উপাদান সংযোগের ফলে এই রামায়ণ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। দীনেশচন্দ্রের মতে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যের সীতা-সরমার কথোপকথনের অংশটি 'চন্দ্রাবতীর রামায়ণ' থেকে গ্রহণ করেছিলেন। মৈমনসিংহ গীতিকায় তার নিজের রচিত ‘মলুয়া’ গীতিকাব্যে এবং তার জীবনী অবলম্বনে পরবর্তী সময়কার কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত ‘চন্দ্রাবতী’ পালায় তার কথা পাওয়া যায়৷ তার জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাঁথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে। তার রচিত রামায়ণ কিছুকাল আগেও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মেয়েরা বিয়ে উপলক্ষে গান করত। চন্দ্রাবতী নিজের কাব্য ছাড়াও পিতা বংশীদাসের মনসামঙ্গল কাব্যের অনেকাংশ রচনা করেছিলেন।

চন্দ্রাবতীর গান ময়মনসিংহে সুপরিচিত এবং সুপ্রচারিত। চন্দ্রকুমার দে বলেছেন, ‘শ্রাবণের মেঘভরা আকাশতলে ভরা নদীতে যখন পাইকগণ সাঁজের নৌকা সারি দিয়া বাহিয়া যায়, তখন শুনি সেই চন্দ্রাবতীর গান, বিবাহে কুলকামিনীগণ নববরবধূকে স্নান করাইতে জলভরণে যাইতেছে, সেই চন্দ্রাবতীর গান, তারপর স্নানের সঙ্গীত, ক্ষৌরকার বরকে কামাইবে তাহার সঙ্গীত, বরবধূর পাশাখেলা, তার সঙ্গীত সে কত রকম।’ চন্দ্রাবতীর লেখা পাশাখেলার একটা সঙ্গীত-
 

চন্দ্রাবতীর জীবনের ইতিহাসটি অনেক করুণ। পরমা সুন্দরী ছিলেন তিনি। বাল্যকাল থেকেই বাবার দেখাদেখি কবিতা লেখা শুরু করেন। গানও লিখতেন। শুধু লিখতেনই না, নিজেও গাইতেন। এত সব গুণের কারণে বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিই চন্দ্রাবতীকে পাবার জন্য উৎসুক ছিলেন। কিন্তু চন্দ্রাবতীর এ বিষয়ে কোনো আগ্রহই ছিল না। তাঁর নিজের খেয়াতরী তখন জয়ানন্দের ঘাটে বাঁধা। মৃদু মৃদু বসন্ত বাতাসে তা দোদ্যুল্যমান।

জয়ানন্দ ছিলেন চন্দ্রাবতীর জনম জনমের সাথী। বাল্যকাল থেকেই পরিচয় তাঁদের। দুজনেই এক সাথে পড়ালেখা করতেন, খেলা করতেন। বেড়ে উঠার সাথে সাথে ভালবাসার রঙ চড়ায় দুজনের মনে। কবিতার ভাষায় প্রকাশ ঘটে তার। দু’জন দুজনকে কবিতা লিখে ভালবাসা জানাতেন। আর এভাবেই এক সময় অন্য বিষয় নিয়েও কবিতা রচনা শুরু করেন তাঁরা। কবি দ্বিজবংশীর পদ্মপুরাণে চন্দ্রাবতী এবং জয়ানন্দ, দুজনেরই কবিতা রয়েছে। দিনে দিনে দুজনের ভালবাসা প্রণয় গাঢ় হতে থাকে। চন্দ্রাবতী প্রাণ-মন সব উজাড় করে দেয় জয়ানন্দের কাছে। তাদের দুজনের বিয়ের কথাবার্তা প্রায় পাকাপাকি। ঠিক এরকম সময়েই ভিমরতিতে ধরে জয়ানন্দকে। এক মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে। শুধু প্রেমে পড়েই খান্ত হয় না, নিজে মুসলমান হয়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে জয়ানন্দ।

জয়ানন্দের এই হঠকারী আচরণ বিশাল এক আঘাত হয়ে আসে চন্দ্রাবতীর জন্য। অল্প বয়সের কোমল হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যায় তাঁর। এই আঘাত সামলাতে শিবপূজায় নিজেকে উজাড় করে দেন তিনি। বাবার কাছে দুটো প্রার্থনা জানান তিনি। ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি শিবমন্দির গড়ে দেওয়া এবং আজীবন কুমারী থাকার বাসনা। কন্যাবতসল পিতা আদরের কন্যার দু’টো আবদারই মেনে নেন। চন্দ্রাবতী নিজেকে উজাড় করে দিয়ে শিববন্দনা করতেন। এর পরে যেটুকু অবসর সময় থাকতো, সেই সময়ে রামায়ণ লিখতেন। চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণ এখনও ময়মনসিংহের কোনো কোনো অঞ্চলে মুখে মুখে গীত হয়ে থাকে। দীনেশ্চন্দ্র সেন তাঁর পূর্ববঙ্গ গীতিকায় চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণকে লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য চন্দ্রাবতী এই রামায়ণ শেষ করতে পারেন নাই। সীতার বনবাস পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছেন। থেমে গেছেন বলার চেয়ে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলা উচিত।

জয়ানন্দের কাছ থেকে চিঠি এলো। দেখা করতে চায় চন্দ্রাবতীর সাথে। চন্দ্রাবতী পিতাকে সব জানালেন। পিতা অসম্মতি জানালেন। তাঁর ভাষ্য হচ্ছে, তুমি যে দেবতার পূজোয় মন দিয়েছো, তাঁরই পূজো করো। চন্দ্রাবতী জয়ানন্দকে পালটা জবাব দিয়ে জানালেন যে, দেখা করা সম্ভব না। তুমি বরং শিবের চরণে মনপ্রাণ সমর্পণ করো। তিনি সর্ব দুঃখহারী। চিঠি পেয়ে উলটো ঘটনা ঘটলো। অনুতপ্ত জয়ানন্দ ছুটে এলো শিবমন্দিরের দিকে। চন্দ্রাবতী তখন শিবপূজায় বিভোর। মন্দিরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। চন্দ্রাবতীকে ডাকার সাহস হলো না জয়ানন্দের। আঙিনার ভিতর সন্ধ্যামালতীর ফুল ফুটেছিল। তা দিয়েই কপাটের উপরে চারছত্র কবিতা লিখে বিদায় নেয় জয়ানন্দ। পূজো শেষ করে দরজা খুলে বের হলেন চন্দ্রাবতী। চোখে পড়লো জয়ানন্দের লেখা কবিতা দরজার কপাটে। কবিতা পড়ে বুঝলেন দেবমন্দির কলংকিত হয়েছে। চন্দ্রাবতী জল আনতে ফুলিয়ার (ফুলেশ্বরী) ঘাটে গেলেন। গিয়ে বুঝলেন সব শেষ হয়ে গেছে। অনুতপ্ত জয়ানন্দ ফুলিয়ার স্রোতধারায় নিজের জীবনস্রোত বিলীন করে দিয়েছে। এই ভয়াবহ শোকে পাথর হয়ে যান চন্দ্রাবতী। এর পরে আর কোনো কবিতা লেখেন নাই তিনি। যে কারণে রামায়ন অসমাপ্ত থেকে যায়। তারপর একদিন শিবপূজার সময় নিজেও বিদায় নেন এই ধরিত্রী থেকে।

চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে সবাই অবশ্য একমত নন। নয়ানচাঁদ নিজেও তার চন্দ্রাবতী পালাগানে চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে কিছু বলেন নাই। কারো কারো মতে নদীর ঘাটে মৃত অবস্থায় জলে জয়ানন্দের লাশ ভাসতে দেখে তীব্র অনুশোচনায় চন্দ্রাবতীও পরবর্তীতে ফুলেশ্বরী নদীর জলে ঝাঁপিয়ে জয়ানন্দের মত অনুগামী হন। আবার কারো মতে, জয়ানন্দের জলে ডুবে আত্মহত্যা বা মৃত্যুর কিছুদিন পরপরই শোকাবিভূত চন্দ্রাবতী মর্মান্তিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। দীনেশ্চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ-গীতিকার ভূমিকায় লিখেছেন, ‘প্রবাদ এই যে, প্রেমাহতা চন্দ্রা জয়চন্দ্রের শব দর্শন করার অল্পকাল পরেই হৃদরোগে লীলা সংবরণ করেন।’ ব্রজেন্দ্রকুমার দে তার মঞ্চনাটক ‘কবি চন্দ্রাবতী- তে দেখিয়েছেন যে, শোক এবং অপমান থেকে বাঁচার জন্য চন্দ্রাবতী নিজেই গিয়েই ফুলেশ্বরীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন।

তবে যেভাবেই হোক না, গভীর হৃদয়ে গভীর আঘাত নিয়ে তীব্র মনোযাতনায়, অসামান্য প্রতিভাবান বাংলার এই প্রথম নারী কবির মৃত্যু হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার মত অভাগিনী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। নিজেকে ধুপের মত পুড়িয়ে তিনি যে কাব্য সৌরভ পরিবেশন করে গিয়েছেন অনাগত সময়ের জন্য তার খবর শহরে মানুষেরা রাখে নি। কিন্তু পল্লীর মানুষেরা তা ভোলে নি। তাদের মুখে গীত হয়ে দুখিনী কবি চন্দ্রাবতী আজো বেঁচে আছেন।

Listen the story on YouTube চন্দ্রাবতী রামায়ণ  কাহিনীঃ



চন্দ্রাবতীর রামায়ণের প্রথম পরিচ্ছদে রয়েছে লঙ্কার বর্ণনা। সেখানকার রাজা রাবণ। লঙ্কাপুরী নির্মাণ করেছিলেন স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা।সেখানে ঘরবাড়ি বিশালাকৃতির, সোনা দিয়ে মোড়া। সুন্দর পুকুর সোনা দিয়ে বাধানো। অপরূপ সুন্দর,  সুগন্ধ ফুলে ফুলে ভরা সেখানকার বাগান। সেইসব ফুল সারা বছর সতেজ থাকে।  সেখানকার সুন্দরী রাক্ষস রমণীরা সর্বদা স্বর্ণ অলঙ্কারে সেজেগুজে থাকে। এমন সুন্দর লঙ্কা পুরীর রাজা হলেন রাবণ। ভয়ংকর রাক্ষসরাজ রাবণের দশটি মাথা। সকল দেবতাগণ তাকে ভয় পায়। একদিন রাবণ স্বর্গ আক্রমণ করল। তার ভয়ে সকল দেবতা স্বর্গ  ছেড়ে পালাতে লাগল। রাক্ষসরাজ রাবণ দেবরাজ ইন্দ্র, যম সহ একাধিক দেবতাকে বন্দী বানিয়ে লঙ্কাপুরীতে আনল। সাথে সাতশ অপ্সরা সুন্দরীকে বন্দী করে নিয়ে এল। লঙ্কায় সকল দেবতাদের রাবণ তার সেবায় নিয়োজিত করে চাকর বানিয়ে রাখল। সুন্দরী অপ্সরা রমণীদের কেউ তার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করল। কেউ অপমান থেকে মুক্তি পেতে আত্মত্যাগ করল।এর সাথে রাবণ স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ, ঐরাবত, উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়া, পুস্পক রথ সহ অজস্র মণিমাণিক্য  লুট করে নিয়ে এল।স্বর্গজয়ের পর রাবণ মর্ত্যলোক আক্রমণ করল। সেখানকার সকল রাজা বিনাযুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করে নিল। মর্ত্যলোকের পর রাবণ পাতাল আক্রমণ করল। সেখানে নাগরাজ বাসুকীও বিনাযুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করল।তিন লোক জয়ের পর রাবণ অরণ্যে তপস্যারত ঋষিমুণিদের আক্রমণ করল এবং তাদের উপর ভীষণ অত্যাচার শুরু করল। দুষ্ট রাজা তাদের বুক চিরে রক্ত সংগ্রহ করে কৌটায় ভরে লঙ্কায় নিয়ে এল।রাবণ সেই কৌটা রাণী মন্দোদরীর হাতে দিল। মন্দোদরী জানতে চাইল সেই কৌটায় কি আছে। রাবণ জানাল সেই পাত্রের বিষ খাইয়ে সে ইন্দ্র যম সহ দেবতাদের হত্যা করবে।এই পর রাবণ বন্দী অপ্সরাদের সাথে আমোদপ্রমোদে মেতে উঠল। রাবণের এই ভ্রষ্টামির খবর গেল মন্দোদরীর কাছে। স্বামীর এমন অপকর্মের কথা শুনে অপমানে লজ্জায় প্রাণ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিল সে। আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে সে কৌটা ভরা রক্ত বিষ ভেবে পান করল। দৈবের ফেরে সেই রক্ত পান করে মন্দোদরী গর্ভধারণ করল। দশ মাস দশ দিন পর মন্দোদরী একটি ডিম প্রসব করল। খবর গেল রাবণের কাছে। রাবণ গনক ডাকল। গনক জানালো, সেই ডিম্ব থেকে এক কন্যা জন্ম নিয়ে চলেছে, সেই কন্যাই হবে লঙ্কার পতনের কারণ। একথা শুনে রাবণ ক্রুদ্ধ হলেন। কেউ বলল, ডিম কেটে ফেল, কেউ বল ডিম ভেঙে ফেল। কিন্ত মায়ের মন তার সন্তানের জন্য কেঁদে উঠল। সে রাবণকে অনুরোধ করল ডিম না ভেঙে নদীতে ভাসিয়ে দিতে। স্ত্রীর কথা মত রাবণ এক শক্তপোক্ত স্বর্ণ কৌটায় ডিমটি বন্ধ করে নদীতে ভাসিয়ে দিল। সেই পাত্র ভাসতে ভাসতে এল জনক রাজার রাজ্য মিথিলা নগরীতে। সেই রাজ্যে মাধব নামে এক জেলে এবং সতা নামে তার স্ত্রী বাস করত। মাধব নদীতে মাছ ধরত, সতা বাড়ী বাড়ী মাছ বিক্রি করত। সেই গরীব অসহায় দম্পতি পর্ণকুঠীরে বাস করত। একদিন সন্ধ্যাবেলা মাধব জেলের জালে সেই স্বর্ণ প্রাত্র উঠল। সে সেই কৌটা বাড়িতে আনল। তার স্ত্রী সতা সে কৌটা অতি ভক্তি ভরে পূজা করতে লাগল। ক্রমে ক্রমে তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ বাড়তে লাগল। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু হল। একদিন রাতে সতা স্বপ্ন দেখল, সেই কৌটা থেকে একটি ছোট্ট মেয়ে বেরিয়ে এসে তার গলা জড়িয়ে বলছে, আমি জনক রাজার মেয়ে। কালকেই আমাকে রাণীর কাছে রেখে এসো। পরের দিন স্বপ্ন মত সতা সেই কৌটা নিয়ে গেল রাণীর কাছে। রানীকে স্বপ্নের কথা জানাল সতা। রানী তাকে গজমতী হার, মণিমুক্তা উপহার দিল। সতা রানীকে অনুরোধ করল, যদি সত্যি সেই কন্যা জন্মায়, তাহলে যেন সতার নামে তার নামকরণ করা হয়। কিছুদিন পর সেই কৌটার ডিম থেকে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম নিল। রাজবাড়ীতে খুশির ঢল নামল। সতার নাম অনুসারে রাণী সেই কন্যার নাম দিলেন সীতা৷ 


অপরদিকে অয্যোধ্যা নগরীর রাজা দশরথের তিন রাণী। কৌশল্যা, কৈকেয়ী এবং সুমিত্রা। তিন রাণী থাকা সত্ত্বেও রাজা অপুত্রক ছিলেন। কিন্তু স্বয়ং বিষ্ণু চার রূপ ধারণ করে জন্ম নেবেন দশরথের ঘরে। পুত্রের আশায় রাজা দশরথ যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। যজ্ঞ করছেন বশিষ্ঠ মুণি। কিন্তু যজ্ঞ করেও কোনো ফল পেলেন না তিনি। দুঃখে রাজা দশরথ মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করে মন্দিরের দরজা বন্ধ করলেন। এমন সময় বিশাল জটাধারী এক ঋষি এলেন। তার ডাকে রাজা বাইরে এলেন। ঋষি যখন তার দুঃখের কাহিনী জানতে পারলেন, তখন তিনি দশরথকে একটি ফল দিয়ে সেটি কৌশল্যাকে দিতে বললেন। সেই মত দশরথ সেই ফল কৌশল্যাকে দিলেন। কৌশল্যা সেই ফল  তিন ভাগ ক'রে বাকী দুই রাণীদের সাথে সমান ভাগ করে খেলেন। যথা সময় তিন রাণী গর্ভধারণ করলেন। দশমাস দশদিন পর মা কৌশল্যার কোল আলো করে এক পুত্র সন্তান জন্মাল। ঋষি বশিষ্ঠ তার নাম দিলেন রামচন্দ্র। 


দ্বিতীয় পরিচ্ছদটির নাম সীতার বারমাস্যা অর্থাৎ সীতার বারো মাসের সুখ দুঃখের কাহিনী। কাহিনীর শুরুতে সীতা বসে রয়েছেন একটি মন্দির প্রাঙ্গনে। সাথে রয়েছে কয়েকজন দাসী।  এই কাহিনী ঘটছে বনবাস এবং লঙ্কাপুরী থেকে ফিরে আসার পর। দাসীরা জানতে চাইল, বনবাসে থাকাকালীন তাকে কোন মাসে কেমন দুঃখ কষ্ট পেতে হয়েছিল। উত্তরে সীতা তার বারো মাসের দুঃখের কাহিনী বর্ণনা শুরু করলেন। 

জন্মদুখিনী সীতা। রামের মত স্বামী পেয়েও দুঃখ তাকে ছাড়েনি৷ মিথিলা নগরীতে তারা চার বোন হেসে খেলে বড় হয়েছে৷ (এখানে চার বোন বলতে সম্ভবত সীতা ছাড়া লক্ষ্মণের স্ত্রী ঊর্মিলা, ভরতের স্ত্রী মান্ডবী, শত্রুঘ্নের স্ত্রী শ্রুতকীর্তির কিথা বলা হয়েছে৷ সীতা ঊর্মিলা হলেন জনকরাজা সীরধ্বজের দুই কন্যা। অপর দুই বোন সীরধ্বজের ভাই কুশধ্বজের দুই কন্যা)। পিতার কাছে এক শক্তিশালী শিব ধনু ছিল। পিতা পণ করেছিলেন, যে সেই ধনু ভঙ্গ করতে পারবে তার সাথে সীতার বিবাহ হবে। দূর দূরান্ত থেকে অনেক বীর এলেন, কিন্তু কেউই সফল হলেন না।

একদিন রাতে সীতা স্বপ্ন দেখলেন, শ্রী রামচন্দ্র তাকে বলছেন, তিনি আসছেন, শিব ধনু ভঙ্গ করে সীতাকে বিবাহ করতে তিনি আসছেন। পরের দিন স্বপ্ন সত্যি হল। গাঢ় শ্যামল বর্ণ শ্রী রামচন্দ্র সাথে ভাই লক্ষ্মণ এবং ঋষি বিশ্বামিত্র এসেছেন মিথিলা নগরীতে। এরপর মিথিলা নগরীর যজ্ঞস্থলে গেলেন রাম। সেখানে অনাহাসে শিবধনু ভঙ্গ করলেন। জনকরাজা তার প্রতিজ্ঞা মত শ্রী রামচন্দ্রের সাথে সীতার বিবাহ দিলেন। মিথিলা নগরীর অনেকে ধন্য ধন্য করে উঠল, বলল, সীতা আদর্শ স্বামী পেয়েছে। আবার কেউ কেউ রামচন্দ্রের দেহের শ্যাম রূপ দেখে ঠাট্টা করল। নবদম্পতিকে দেখে তারা মজা করে বলল, কালো মেঘের গায়ে যেন বিদ্যুৎ লেগে রয়েছে!নবদম্পতি অযোধ্যায় এলেন। সেখানে সুখে দিন কাটছিল। লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন দাদা রামের সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। একসময় শ্রী রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের সময় হল। তিনি হবেন অযোধ্যার রাজা। কিন্তু কুজি  মন্থরার প্ররোচনায় বিমাতা কৈকেয়ী তাকে বনবাসে পাঠাতে চাইলেন।শুরু হল মাতা সীতার বারমাস্যা অর্থাৎ বারো মাসের কাহিনী৷ বৈশাখ মাসে রাম লক্ষ্মণ সীতা বনবাসের উদ্দেশ্যে অরণ্যে প্রবেশ করলেন। জ্যৈষ্ঠের প্রচন্ড দাবদাহে প্রভু রামচন্দ্রের দেহ কালো হতে লাগল।  ঘুরতে ঘুরতে তারা এসে পৌছালো গোদাবরী কূলে পঞ্চবটী অরণ্যে। লক্ষ্মণ, রাম-সীতার জন্য লতা পাতা দিয়ে কুঠীর বানালেন। সেই কুঠীরে রাম সীতা বাস করতে লাগলেন। ভাই লক্ষ্মণ বৃক্ষতলে বসে দিবারাত্র পাহারায় সজাগ রইলেন।রাজ্যসুখ ছেড়ে অরণ্যে প্রকৃতির মধ্যে তারা সুখে বসবাস করছিল। একদিন মা সীতা কুঠীরের সামনে একটি সোনার হরিণ দেখতে পেল। সীতার অনুরোধে রাম সেই সোনার হরিণ ধরতে গেলেন, যাওয়ার সময় তিনি লক্ষণকে সীতা মাতার রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তারা রামের করুণ আর্তনাদ শুনল, রাম লক্ষণের উদ্দেশ্যে বলছে, ভাই লক্ষণ, আমায় বাচাও, রাক্ষসের হাতে প্রাণ গেল। একথা শুনে সীতা মাতা লক্ষ্মণকে পাঠালেন দাদাকে রক্ষা করতে। সীতার আদেশে লক্ষ্মণ দাদাকে বাচাতে কুঠীর ত্যাগ করলেন। ঠিক এমন সময়, শিবশংকর নামে এক যোগী ভিক্ষা চাইতে এলেন।  একাকী সীতা মাতার থেকে সেই যোগী বনের ফল ভিক্ষা চাইলেন। মাতা সীতা ভিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কুঠীরের বাইরে এলে, সেই রাক্ষস তাকে রথে তুলে নিল। সীতা নিজের গহনা দিয়ে তাকে আঘাত করার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু সেই বিশাল রাক্ষসের শরীরে তা কোনো প্রভাব ঘটাল না। ভয়ে সীতা মা অজ্ঞান হিয়ে গেলেন। যখন হুশ ফিরল, তখন তিনি লঙ্কার অশোক কাননে। তাকে ঘিরে রয়েছে রাক্ষসী চেড়ীর দল। প্রাণপ্রিয় স্বামী রামচন্দ্রের কথা ভেবে ভেবে তিনি ক্ষুধা তৃষ্ণা ত্যাগ করলেন। তার চোখের জলে অশোকবন প্লাবিত হতে লাগল।এর পর আষাঢ় এল।মা সীতার চোখের জলের কাছে আষাঢ়ের প্রবল বর্ষণ কম মনে হতে লাগল। শ্রাবণ মাসে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, রামের সাথে সুগ্রীবের সাক্ষাৎ ঘটেছে। ভাদ্র মাসে রামভক্ত হনুমান এলেন অশোকবনে মাতা সীতার কাছে। হনুমান রামচন্দ্রের হাতের আংটি দেখিয়ে শ্রীরামের বার্তা দিলেন মাতা সীতাকে। আশ্বিন মাসে সীতা স্বপ্ন দেখলেন, রাম দেবী অম্বিকার অকাল বোধন পূজা করছেন। কার্তিক মাসে দিন ক্রমশ ছোট হয়ে আসে। মা সীতা কেদে কেদে দিন কাটায়। অগ্রহায়ণ মাসে তিনি খবর পেলেন, বানর সেনারা গাছ পাথর দিয়ে সমুদ্রে সেতু বানাচ্ছে। পৌষ মাসে বানর সেনা লঙ্কানগরী চারিপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে। মাঘ মাসে সীতা স্বপ্ন দেখলেন, রাবণ পুত্র ইন্দ্রজিত রামচন্দ্রের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। চারিদিকে রাক্ষসরা হাহাকার করছে। ফাল্গুন মাসে স্বপ্নে দেখলেন, লঙ্কাপতি রাবণ সবংশে নিহত হয়েছেন। তিনি শুনতে পেলেন, বানরসেনাগণ রামচন্দ্রের গুণগান করছে। চৈত্রে মাতা সীতা ফিরে পেলেন প্রাণপ্রিয় স্বামী রামচন্দ্রকে।  সীতার বারমাস্যা তথা দ্বিতীয় অধ্যায় এখানে সমাপ্ত হল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদে বনবাস পরবর্তীকালে রামসীতার কাহিনী রয়েছে।  একদিন রাম সীতা প্রাসাদে রয়েছেন। সাথে রয়েছে তাদের সখীরা। রাম সীতা পাশা খেলায় মত্ত হয়েছেন। সিদ্ধান্ত হয়েছে, রাম হারলে তিনি তার আংটি সীতাকে উপহার দেবেন, আর সীতা হারলে তিনি রামকে আলিঙ্গন করবেন। প্রথমে রাম হারলেন। তিনি তার আংটি সীতাকে দিলেন। পরের বার সীতা হারলেন। সখীরা জোর করে তাদের আলিঙ্গন করালো। রাম সীতা মাকে বর চেয়ে নিতে বললেন। মা সীতা বললেন, তিনি বনবাসকালের গোদাবরী কূলের সেই কুঠীর স্থল দেখতে চান। সীতার ইচ্ছা মত, রামচন্দ্র বললেন, পরের দিন ভাই লক্ষ্মণের সাথে তাকে সেই স্থান দর্শনে পাঠাবেন। 

এর পর সীতা রয়েছেন তার শোবার ঘরে, স্বর্ণ পালঙ্কে শায়িত আছেন তিনি। এমন সময় তার ননদিনী কুকুয়া সেখানে প্রবেশ করল। কুকুয়া,  কৈকেয়ীর কন্যা, ভরতের বোন। সে দুষ্ট মন্থরার কাছে লালিত পালিত হয়েছে৷ তার বিয়ে হয়েছিল রাজার ঘরে৷ কিন্তু সেখানে তার কপট চরিত্রের জন্য ঠাই জোটেনি। সে স্বামীকে ওষুধ খাইয়ে পাগল করেছে। দেবরকে ঘরছাড়া করেছে। দশ বছর শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে সে বপেরবাপের বাড়িতেই রয়েছে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে সে মজা পায়৷

সেই কুউদ্দেশ্যে সে সীতার শয়নকক্ষে এল। শায়িত সীতার থেকে সে রাবণের ভীষণ রূপের বর্ণনা শুনতে চাইল। মাতা সীতা সেই ভয়ংকর অতীতকে স্মরণ করে মূর্ছা গেলেন৷ সখীরা কুকুয়াকে এমন প্রশ্ন করতে বারণ করলেন৷ কারণ এমন প্রশ্ন করায় রাজার নিষেধ আছে৷ কিছুক্ষণ পর সীতার জ্ঞান ফিরল। কুকুয়া আবার একই প্রশ্ন করলেন। সীতা জানালেন, তিনি কখনো রাবণের মুখ দর্শন করেননি। তিনি শুধু তার ছায়া দেখেছেন। কুকুয়া সেই দশমুখ ছায়া কেমন ছিল তা হাতপাখার উপর একে দেখাতে বললেন৷ সীতা বাধ্য হয়ে সেই ছায়া  হাতপাখার উপর আঁকলেন। তারপর ক্লান্ত হয়ে সীতা ঘুমিয়ে পড়লেন। সেই সুযোগে সীতা সেই হাতপাখা ঘুমন্ত সীতার বক্ষে রেখে দিল। তারপর সে গেল রামের কাছে। রামকে সে অভিযোগের সুরে জানালো, সীতা এখনো রাবণকে ভুলতে পারেননি। রামের অবর্তমানে সীতা রাবণের জন্য চোখের জল ফেলেন। এখন সে রাবণের প্রতিমূর্তি বক্ষে ধারণ করে শায়িত আছে। দুষ্টা কুকুয়ার কুমন্ত্রনায় রামের হৃদয় বিষাক্ত হয়ে উঠল। কুকুয়াকে সাথে নিয়ে সে সীতার শয়নকক্ষের দিকে ছুটে গেলেন। (অসমাপ্ত)

♦♦আসল চন্দ্রাবতী রামায়ণঃ   https://drive.google.com/file/d/1jeegotcV0-t5HNK3561Y2B0Yhlv2lx9j/view?usp=drivesdk


Comments

Post a Comment