কালভৈরব || Story of Kalbhairav
বারানসীর কাশীর বিশ্বেশ্বরগঞ্জে কোতোয়ালি থানা। থানার কোতয়ালের চেয়ারে কোনো মানুষ বসেননা, বা আরো ভালো ভাবে বলতে গেলে বসার সাহস দেখান না। সেই চেয়ারে বিরাজমান স্বয়ং কাল ভৈরব। কাল ভৈরব হলেন কাশীর কোতয়াল। তার আসনে বসার ক্ষমতা কারো নেই। দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত আধিকারিক পাশের চেয়ারে বসে দ্বায়িত্বভার পালন করেন। থানার অদূরেই কাশীর বিখ্যাত কাল ভৈরব মন্দির। সেই মন্দিরে অবস্থান করছেন স্বয়ং মহাকাল।
কালভৈরব মহাদেবের অবতার। তিনি ভয়ংকর।
কালভৈরব মহাদেবের অবতার। তিনি ভয়ংকর।
বিনাশকারী। পদ্মের মত চক্ষু, বাঘ্র চর্ম পরিহিত, গলায় সর্পকুন্ডল, নরমুন্ডমালা। নীলকন্ঠী। বাহন কুকুরের উপরে তাঁর অধিষ্ঠান। হাতে ত্রিশূল, ডমরু এবং এক ব্রাহ্মণের দেহহীন মস্তক। স্বয়ং মহাদেব তাকে কাশীর কোতয়াল বা পালককর্তা নিযুক্ত করেছেন। কাশীতে স্বয়ং যমও প্রবেশ করেননা। কালভৈরব কাশীবাসী প্রজাদের রক্ষা করেন এবং তাদের পাপের সাজা তিনিই দেন। ১৮ মহাপুরাণের একটি শিব মহাপুরাণের শতরুদ্রসংহিতার অষ্টম অধ্যায়ে কালভৈরবের কাহিনী রয়েছে। আসুন জেনে নিই, সেই কাহিনী।
কালভৈরবের জন্ম ও তাঁর মাহাত্ম্য উল্লেখ আছে মহা শিবপুরাণের শতরুদ্রসংহিতায়।
একবার সকল দেবতাগণ এবং ঋষিগণ প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে জানতে চাইলেন, একমাত্র অপরিবর্তনীয় সত্তা কি? উত্তরে ব্রহ্মা বললেন, তিনিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা, তাই তিনিই সেই একমাত্র সত্তা। এই শুনে বিষ্ণু ক্রোধিত হলেন এবং নিজেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা দাবি করলেন। দুই দেবতার এই বিবাদ দেখে সকলে চার বেদের স্মরণাপন্ন হলেন। দেবতাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ঋকবেদ বললেন যে, যার মধ্যে পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ এই পঞ্চ ভূতের অবস্থান, যা থেকে এই সকল কিছুর সৃষ্টি, সেই রুদ্র হলেন একমাত্র সত্তা।
যজুর্বেদ বললেন, সকল ধ্যান তপস্যা দ্বারা যার সাধনা করা হয়, সেই একমাত্র জগত-কর্তা হলেন শিব। সামবেদ বললেন, শিব-ই সেই শক্তি যার দ্বারা বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড ঘূর্ণিত হচ্ছে, আলোকিত হচ্ছে। অথর্ববেদ জানালেন, সকল দেবতাদের দেব হলেন শিব।
চার বেদের এই কথা শুনে ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু মেনে নিতে পারলেন না। তারা তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, যার শরীর ধুলায় আবৃত, যে নগ্ন, পীত বর্ণ, সাপ বেষ্টিত কন্ঠ, সে কিভাবে এই জগতের প্রধান হতে পারে! ঠিক এমন সময়, এক প্রবল আলোক জ্যোতি বিচ্ছুরিত হল। সেই আলোকস্তম্ভ থেকে মহাদেব প্রকাশ পেলেন। তার সেই প্রবল আলোর তেজে ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক ঝলসে গেল। মহাদেবকে দেখে ব্রহ্মা বললেন, তোমাকে তো আমি সৃষ্টি করেছি, তুমি ভয় পেও না, তুমি আমার কাছে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ কর। ব্রহ্মার এমন অহংকারী বক্তব্য শুনে মহাদেব ক্রধিত হলেন। তিনি এক ভয়ংকর পুরুষ সৃষ্টি করলেন। সেই পুরুষকে মহাদেব পাপীদের সংহারের দ্বায়িত্ব দেন। এমনকী স্বয়ং যমও তাঁর কাজে বাঁধা দিতে পারবেন না। মহাদেব সেই পুরুষকে কাশীতে অবস্থানের আদেশ দিলেন। দেবাদিদেব তাঁর নাম দিলেন কালভৈরব।
দ্বায়িত্ব পেয়েই কালভৈরব পাপের সাজা দিতে উদ্যত হলেন। অহংকারের কারণে ব্রহ্মার যে পঞ্চম মস্তকের সৃষ্টি হয়েছে, যে মুখে তিনি দেবাদিদেবের উদ্দেশ্যে তাচ্ছিল্য এবং উপহাস করেছেন, তাঁর প্রতি ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন, কালভৈরব সেই পঞ্চমমস্তকটি বাম হাতের আঙুলের নখের দ্বারা ছিন্ন করলেন।
কালভৈরবের থেকে এই সাজা পেয়ে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু স্তম্ভিত হলেন। তারা দেবাদিদেবকে শ্রেষ্ঠ মেনে নিলেন।
ব্রহ্মা বিষ্ণু যখন নিজেদের শুধরে নিলেন, তখন মহাদেব তাদের উপর প্রসন্ন হলেন এবং কালভৈরবকে ব্রহ্মহত্যার প্রায়শ্চিত্ত করার আদেশ দিলেন। সেই উদ্দেশ্যে মহাদেব "ব্রহ্মহত্যা" নামে এক নারীর সৃষ্টি করেন। এবং বলেন, সেই নারী কালভৈরবের সাথে সাথে ঘুরে বেড়াবে যতক্ষন না সেই নারী বারানসী পৌছায়। ব্রহ্মার ছিন্ন মস্তক কালভৈরবের হাতে আটকে রইল। হাতে আটকে থাকা ব্রহ্মার মস্তক এবং ব্রহ্মহত্যা নামক নারীর হাত থেকে মুক্তি পেতে তিনি মহাদেবের আদেশ অনুযায়ী "কাপালিক" পন্থা অবলম্বন করলেন এবং নানা তীর্থক্ষেত্রে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়ালেন। যখন তিনি বারানসীর কাশীতে এসে পৌছালেন, তখন সেই ব্রহ্মামূর্তি কালভৈরবের দেহ থেকে ছিন্ন হল। এই দেখে ব্রহ্মহত্যা নামের সেই নারীও তাকে মুক্তি দিলেন। কাশীর যে স্থানে কালভৈরব ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ থেকে মুক্তি লাভ করলেন, সেই স্থানের নাম হল "কপালমোচন"।
শিবমহাপুরাণ অনুসারে, মার্গশিরা মাস অর্থাৎ অগ্রহায়ন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে মহাদেব কালভৈরবকে সৃষ্টি করেছিলেন। এই দিন কোনো ব্যক্তি অনিদ্রা উপবাস পালন করলে তার পাপমুক্তি ঘটে। এছাড়াও কাশীর কপালমোচনে কালভৈরবকে স্মরণ করলে পাপমুক্ত হওয়া যায়।
কাহিনীটি বিস্তারিত জানতে নিচের ইউটিউব ভিডিওটি দেখে নিনঃঃ




Comments
Post a Comment