মধু-কৈটভ বধ Story of Madhu Kaitabha from Puran

মধু-কৈটভ বধ
 

 "মধুকৈটভ বিধ্বংসী বিধাতৃবরদে নমঃ। 

রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি, দ্বিষো জহি।।" 


 মধু কৈটভ- এই দুই দানব ভাই এর কাহিনী রয়েছে মার্কন্ডেয় পুরাণ এবং দেবী ভাগবত পুরাণে। মার্কন্ডেয় পুরাণের ৮১ তম অধ্যায় যা আমাদের কাছে শ্রী শ্রী দেবী ভাগবতম বা শ্রী শ্রী চন্ডী নামে পরিচিত, সেই অধ্যায়ে আমরা এই কাহিনী পাব। তবে এই কাহিনী আরো বিশদে পাব দেবী ভাগবতপুরাণের ছয় নম্বর অধ্যায়ের প্রথম, দ্বিতীয় স্কন্দে। প্রসঙ্গত, এই দুই পুরাণই লিখেছেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ব্রহ্মার একদিনকে বলা হয় এক কল্প। প্রতিটি কল্প চোদ্দটি ভাগে বিভক্ত। এই প্রতিটি ভাগ মন্বন্তর নামে পরিচিত। বর্তমানে আমরা রয়েছি ব্রহ্মার বয়সের ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে ৫১ তম বছরের প্রথম দিনের সপ্তম মন্বন্তরে। এই কল্পের দ্বিতীয় মন্বন্তরটি ছিল স্বরোচিষ মন্বন্তর। এই মন্বন্তরকালে রাজা সুরথ এবং সমাধি নামে এক বৈশ্যকে মেধস মুণি দেবী ভাগবতীর যে মাহাত্ম্য শোনাচ্ছেন সেই কাহিনীটি রয়েছে মার্কন্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যম অংশে। সুরথ নামে এক রাজা শত্রু দ্বারা পরাজিত হয়ে, নিকটজনের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন গভীর অরণ্যে মেধস মুণির আশ্রমে। যে রাজ্য থেকে তিনি বিতাড়িত, যে আত্মীয়রা তাকে আশ্রয় দেয়নি, জঙ্গলে এসে রাজা তার রাজ্য, রাজ্যবাসী, আত্মীয়পরিজন নিয়ে চিন্তিত। সেখানে তার সাথে সাক্ষাৎ হল সমাধি নামে এক বৈশ্যের। অর্থের লোভে তার স্ত্রী পুত্র তাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। সেই বৈশ্যও তার স্ত্রী পুত্র কেমন আছে সেই ভেবে ব্যাকুল হচ্ছেন, অথচ তারাই তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। রাজা সুরথ এবং সমাধি মেধস মুণির থেকে এমন হওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। উত্তরে মেধস মুণি জানালেন, এই সমগ্র জগত দেবী মহামায়া আদ্যাশক্তি দেবী ভাগবতীর যোগনিদ্রার বশীভূত। তখন রাজা সুরথ এবং সমাধি দুজনেই দেবী মাহাত্ম্য শুনতে চাইলেন। মেধস মুণি তাদের দেবী মাহাত্ম্য কাহিণী বর্ণনা করলেন। ব্রহ্মার একদিন বা এক কল্পের শেষে সমগ্র জগত জলদ্বারা পরিপূর্ণ। কল্পান্তে প্রলয়ের বর্ণনা পাই বিষ্ণুপুরাণ থেকে। বিষ্ণুপুরাণের ষষ্ঠ অংশে তৃতীয় এবং চতুর্থ অধ্যায়ে কল্পের শেষে প্রলয় সম্বন্ধে উল্লেখ পাই। ব্রহ্মার একটি দিন বা এক কল্প শেষ হওয়ার পর সমপরিমান রাত হয়। এই রাতে নৈমিত্তিক প্রলয় ঘটে। ব্রহ্মার একটি দিন বা কল্পের শেষে ত্রিভুবন প্রচন্ড তাপে দগ্ধ হয়। পৃথিবীর সমস্ত জল শুকিয়ে যায়। সাতটি সূর্যের জন্ম হয়। সেই প্রচন্ড তাপে পৃথিবী প্রায় শত বছর ধরে জ্বলতে থাকে। এর পরবর্তী শত বছর প্রবল বৃষ্টিতে সমস্ত তাপ শীতল হয়ে ত্রিভুবন সম্পূর্ণ জলমগ্ন হয়। সেই জলমগ্ন পৃথিবীতে শ্রী শ্রী বিষ্ণু যোগনিদ্যার আশ্রয় নিয়ে শেষনাগশজ্জায় অনন্তনিদ্রায় শায়িত হন। একটি কল্পের সমপরিমান সময়ব্যাপী রাতের শেষ বিষ্ণু জেগে ওঠেন এবং পুনরায় জগত সৃষ্টি করেন। এবার আসি মার্কন্ডেয় পুরাণ ও দেবী ভাগবত পুরাণের কাহিনীতে৷ এমন একটি কল্পান্তে শেষ নাগে শায়িত আছেন শ্রী বিষ্ণু। তার নাভিকমলে অধিষ্ঠিত ব্রহ্মা সৃষ্টিকার্যে ব্যস্ত। এমন সময় বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে জন্ম নিল দুই দানব-মধু ও কৈটভ। জলমগ্ন পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া মধু ও কৈটভ নামে এই দুই অসুর চিন্তা করলেন, জনমানবহীন এই পৃথিবীতে তারা ছাড়া আর অন্য কোনো প্রাণী নেই কেন! কিভাবে তারা এখানে এল! তাদের জন্ম হল কিভাবে! তাদের পিতা মাতা কারা! সর্বশক্তিমান দেবী তাদের সৃষ্টি করেছেন। এমন চিন্তায় যখন তারা মগ্ন, তখন তারা এক অতি পবিত্র দেবীমন্ত্র শুনতে পেলেন। দুই ভাই সেই মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। এইভাবে তারা দুইজন একাগ্রচিত্তে ক্ষুধা তৃষ্ণা ত্যাগ করে এক সহস্র বছর সেই মন্ত্র জপ করলেন। তাদের এই তপস্যায় তুষ্ট হয়ে সর্বশক্তিমান দেবী মহামায়া আদ্যাশক্তি তদের সামনে প্রকট হলেন। দেবী তাদের বর চেয়ে নিতে বললেন। দুই ভাই দেবীর কাছে প্রার্থনা করলেন, তাদের মৃত্যু যেন তাদের ইচ্ছা অনুসারে হয়। দেবী তাদের বর দিলেন, মধু কৈটভের মৃত্যু তাদের ইচ্ছা অনুসারে হবে, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো সুর-অসুর তাদের হত্যা করতে পারবে না। দেবী আদ্যাশক্তির এই বরদানের ফলে দুই ভাই মহাশক্তিমান হয়ে উঠলেন। একদিন তারা দেখলেন, অনন্ত সজ্জায় শায়িত ভগবান বিষ্ণুর নাভিকমলে অধিষ্ঠিত রয়েছেন ব্রহ্মা। দুই ভাই ব্রহ্মাকে যুদ্ধে আহবান করলেন নতুবা সেই পদ্মাসন ত্যাগ করতে বললেন। ব্রহ্মা মনে মনে ভাবলেন, সাম (মীমাংসা), ভেদ (মতানৈক্য), দান (উপহার দান), দ্বন্দ্ব (যুদ্ধ) - এই চার প্রকারে শত্রুকে দমন করা যায়। কিন্তু এইগুলির কোনোটি দ্বারা এই দুই অসুরকে দমন সম্ভব নয়। তাই ব্রহ্মা মনে মনে ভগবান বিষ্ণুর জপ করতে লাগলেন। অনেক প্রার্থনা করার পরেও অনন্ত সজ্জায় শায়িত ভগবান বিষ্ণুকে জাগাতে ব্যর্থ হলেন ব্রহ্মা। অবশেষে ব্রহ্মা বুঝলেন, বিষ্ণুর এই নিদ্রা স্বাভাবিক নিদ্রা নয়। তিনি দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়ার যোগনিদ্রা দ্বারা আচ্ছাদিত রয়েছেন। তাই ব্রহ্মা দেবীর মহামায়ার তপস্যা শুরু করলেন এবং বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে মুক্তি দিতে দেবী মহামায়ার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। ব্রহ্মার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেবী বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে মুক্তি দিলেন। নিদ্রা ছেড়ে জেগে ওঠার পর ব্রহ্মা, বিষ্ণুকে তার বিপদের কথা জানালেন। বিষ্ণু ব্রহ্মাকে আশ্বস্ত করে দুই অসুর ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করতে গেলেন। তাদের মধ্যে পাঁচ হাজার বছর যুদ্ধ চলল। দীর্ঘ লড়াইয়ে বিষ্ণু ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু দুই ভাইয়ের শরীরে ক্লান্তির কোনো লক্ষন দেখা গেল না। বিষ্ণু জানতে পারলেন, দেবী মহামায়ার ইচ্ছামৃতয়ুর বরে দুই ভাই অজেয়৷ এমন সময় বিষ্ণুকে ক্লান্ত দেখে দুই অসুর বললেন, "আপনি কি যুদ্ধ করে ক্লান্ত? তাহলে আপনি আমাদের কাছে পরাজয় স্বীকার করুন, নতুবা যুদ্ধ করুন। আপনাকে হত্যা করে আমরা ব্রহ্মাকে বধ করব।" বিষ্ণু বুদ্ধিমত্তার সাথে উত্তর দিলেন, " তোমরা দুই ভাই, আমি একা। এই অসম লড়াইয়ে তোমাদের এক ভাই যখন লড়ছে, অপর ভাই বিশ্রাম পাচ্ছ। আমি একা লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাই কিছুক্ষণের জন্য লড়াই স্থগিত রেখে বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হোক।" বিষ্ণুর এই প্রস্তাবে অসুর ভাইরা রাজি হলেন। বিশ্রামকালে বিষ্ণু দেবী আদ্যাশক্তির স্মরণাপন্ন হলেন। দেবী মহামায়া বিষ্ণুকে আশ্বস্ত করে বললেন, " আমি দুইভাইকে আমার মায়া দ্বারা আচ্ছন্ন করব, সেই সময় অতিদ্রুত তুমি দুই অসুরকে বধ করবে।" দেবীর থেকে এই আশ্বাস পেয়ে বিষ্ণু যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে গেলেন। মধু-কৈটভ এবং বিষ্ণুর মধ্যে আবার প্রবল যুদ্ধ শুরু হল। কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর ভগবান বিষ্ণু দেবী মহামায়ার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তার চাহনিতে সাহায্যের প্রার্থনা পেয়ে দেবী আদ্যাশক্তি দুই ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। দেবীর মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে দুই অসুর তাকালেন দেবীর চোখের দিকে। দেবীর অপরূপ দুই চোখের দৃষ্টিতে মোহগ্রস্ত হলেন মধু-কৌটভ। এমন সময় বিষ্ণু দুই ভাইকে বললেন, "ওহে, দুই মহাশক্তিধর, তোমাদের প্রবল পরাক্রমে আমি অতি সন্তুষ্ট হয়েছি। তোমরা তোমাদের ইচ্ছা মত বর চাও, আমি তোমাদের বরদান করতে চাই।" মধু-কৌটভ বিষ্ণুর এই প্রস্তাবে হেসে উঠলেন। তারা বললেন, " আমরা ভিক্ষুক নই, আমরা বর দেই, নিই না! আপনি আমাদের থেকে বর প্রার্থনা করুন, আমরা আপনার ইচ্ছা পূরণ করব।" উত্তরে বিষ্ণু বললেন, "তোমরা যদি আমায় বর দিতে চাও, তাহলে আমি বর চেয়ে নিচ্ছি। আমি বর চাই, তোমরা দুই ভাই আমার হাতে মৃত্যুবরণ কর।" বিষ্ণুর এই বর প্রার্থনায় মধু-কৌটভের হুঁশ ফিরল। তারা বিষ্ণুর চাতুরী বুঝতে পেরে বললেন, "আমরা আপনার বর পূরণ করব। কিন্তু আমাদের স্থলে হত্যা করতে হবে, সেখানে জল থাকলে হবে না।" সেই সময় চারিদিক জলমগ্ন, স্থলের চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু, বিষ্ণু দুইভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হলেন। তিনি নিজ উরুদেশ জলের উপর রেখে জলশূন্য স্থলভাগ সৃষ্টি করলেন। এই দেখে দুই ভাই নিজেদের দেহ দশ সহস্র যোজন বাড়িয়ে ফেলল। ভগবান বিষ্ণু নিজের উরু তার দ্বিগুণ বাড়ালেন। উপায় না দেখে মধু-কৌটভ নিজেদের মস্তক বিষ্ণুর উরুতে স্থাপন করলেন। ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দ্বারা তাদের মস্তক ছেদন করে দুই ভাইকে হত্যা করলেন। তাদের দুই ভাইয়ের দেহ থেকে নির্গত মেদ দ্বারা পৃথিবী ভরে গেল। সেই কারণে পৃথিবীর নাম হল মেদিনী। 
 [তথ্যসূত্রঃ বিষ্ণুপুরাণ, দেবী ভাগবতপুরাণ ] 
 
লেখায়ঃ Prasenjit Adak Prasenjit Adak © Knowledge Tree Education 
 
(ছবিটি সংগৃহীত) 
 
সাথে থাকুনঃ 
🔴 Youtube      👉 www.youtube.com/KNOWLEDGETREEIndia 
🔴Facebook     👉 www.facebook.com/KnowledgeTreeEducationIndia 
🔴I nstagram   👉 www.instagram.com/knowledge.tree.education 
🔴 Twitter        👉 www.twitter.com/KnowledgeTreeIn 
 #Email          👉 mail2knowledge.tree@gmail.com #knowledgeTreeEducation 
 
🔴 Read more: https://prasenjitmythology.blogspot.com https://knowledgetreeindia.blogspot.com

Comments

Popular Stories on this blog

Ramayan Written by Lady Poet : Chandravati Ramayan চন্দ্রাবতী এবং প্রথম মহিলা কবির লেখা বাংলা রামায়ণ "চন্দ্রাবতী রামায়ণ"

Brahma & Saraswati : Relation Explained! ব্রহ্মা-সরস্বতীঃ কেন পিতা কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন?