ব্রজধামের হোলি কেমন ভাবে পালন হয় | Braj ki Holi | FULL STORY


 

 গ্রীষ্ম, বরষা, শরত, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত- ছয়ে ষড় ঋতু। আমাদের এই ঋতুচক্রের শেষ উতসব দোল বা হোলি। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে আমরা রঙের খেলায় মেতে উঠি। দোল বা হোলি কেন পালিত হয়, তা নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। পুরাণ মতে, এইদিন ভগবান বিষ্ণু নরসিংহ অবতারে অসুররাজ হিরণ্যকশিপুকে বধ করেছিলেন। আবার একটি কাহিনী অনুসারে, প্রেমের দেবতা মদন দেব নবদম্পতি শিব -পার্বতীর মধ্যে প্রেম জাগরণ করতে শিবকে প্রেম বানে বিদ্ধ করেন। ক্রুদ্ধ শিবের রোষানলে কামদেব ভষ্ম হয়ে যান। তখন তার স্ত্রী রতির দীর্ঘ তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শেষমেষ কামদেব প্রাণ ফিরে পান ফাল্গুন পূর্ণিমার দিন। এছাড়াও এই পবিত্র দিনে শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মলাভ করেছিলেন। হোলি নিয়ে নানা অজানা কাহিনী সম্বলিত দুটি ভিডিওর লিঙ্ক দেওয়া রইল ডেসক্রিপশনে। চাইলে দেখে নিতে পারেন। আনন্দের এই উতসবে একে অপরকে রঙ মাখানোর প্রচলন হয়েছে রাধা-কৃষ্ণের হোলিখেলা থেকে। মথুরাতে কংসের কারাগারে বন্দী বসুদেব-দেবকীর পুত্র কৃষ্ণকে জন্মের পরেই গোকুলে নন্দরাজার গৃহে রেখে আসেন বসুদেব। শিশুজীবনের প্রাথমিক কিছু বছর গোকুলে কাটানোর পর কংসের পাঠানো রাক্ষসদের হাত থেকে কৃষ্ণকে রক্ষা করতে তার পরিবার আসেন বৃন্দাবনে। তারপর সেখান থেকে তারা চলে যান নন্দগাওতে। নন্দগাও থেকে মাত্র ১০ কিমি দূরে বরসনা গ্রাম। এই গ্রামের মেয়ে ছিলেন রাধা। 

সারা ভারতে দোল বা হোলিউৎসব ধুমধাম করে পালন হলেও গোকুল-বৃন্দাবন-নন্দগাও-বরসনাতে হোলির পালন ভিন্নরকম যা এক আলাদা উন্মাদনা সৃষ্টি করে। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হোলি বা দোল পালন হলেও ব্রজভূমিতে হোলি উতসব পালন শুরু হয়ে যায় এক সপ্তাহ আগে থেকে। 

প্রথমে বলি, নন্দগাও ও বরসনা গ্রামের হোলি খেলার কথা। এই দুই গ্রামের মধ্যে হোলি খেলা শুরু হয়েছিল রাধা কৃষ্ণের হোলি খেলা থেকে। আর সেই প্রথা আজও সমান উদ্দিপনায় চলছে। হোলির আগে ফাল্গুন মাসের শুক্লা পক্ষের অষ্টমী তিথিতে বরসনা গ্রামে পালিত হয় ফাগ আমন্ত্রণ উতসব। নন্দগাও এর গ্রামবাসীরা সেদিন বরসনা গ্রামে আসেন হোলি খেলার নিমন্ত্রণ জানাতে। এই বরসনা গ্রামে ব্রহ্মগিরি পাহাড়ের উপর রয়েছে রাধারাণী মন্দির। সেইদিন রাধারাণী মন্দিরে পালন হয় লাড্ডু হোলি। কৃষ্ণের প্রিয় হলুদ রঙের লাড্ডু এক অপরের দিকে ছুড়ে এই হোলি পালন করে বরসানাবাসী। 

পরের দিন বরসনা গ্রামে পালিত হয় লাঠমার হোলি। কথিত আছে, শ্রীকৃষ্ণ তার বন্ধুদের নিয়ে বরসনা গ্রামে আসতেন,  রাধা ও অন্য গোপিনীদের রঙ মাখাতে।  আর সেই গোপিনীর দল লাঠি নিয়ে তাদের তাড়া করতেন। সেই প্রথা আজও চলে বরসনাতে। নন্দগাও এর পুরুষরা রং খেলতে বরসনা গ্রামে আসে। সাথে আনে ঢাল। এরপর চলে দুই গ্রামের মধ্যে হোলিখেলা। তারপর প্রথা মেনে বরসনা গ্রামের মেয়েরা নন্দগাও এর পুরুষদের ঢালে লাঠি দিয়ে প্রতীকী আঘাত করেন। 

এর পরের দিন বরসনা গ্রামের পুরুষরা ঢাল হাতে যায় নন্দগাওতে৷ বরসনা গ্রামের মত নন্দগাও এর মহিলারাও লাঠি দিয়ে পুরুষদের ঢালের উপর আঘাত করতে থাকে। এইভাবেই মজার ছলে হোলি পালন হয় রাধা কৃষ্ণের গ্রামে। সেই সঙ্গে রঙ মাখানো চলে। দুই গ্রামের নারী পুরুষ হোলির রঙে রেঙে ওঠে। 

এবার বলি, গোকুলে কিভাবে হোলি পালন হয়। নন্দগাও আসার আগে, জন্মের পরের কয়েক বছর ছোট্ট কৃষ্ণ গোকুলে বাল্যকাল কাটিয়েছিলেন। দুরন্ত কৃষ্ণকে ভয় দেখিয়ে শান্ত করার জন্য গোকুলের গোপিনীরা হাতে ছড়ি রাখত। প্রতি বছর গোকুলবাসীর হোলি পালনের মধ্যে দিয়ে সেই স্মৃতি জীবন্ত হয়ে ওঠে। দোল পূর্ণিমার কয়েকদিন আগে ফাল্গুন মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বাদশীর দিন গোকুলের রাস্তায় দোলনায় শায়িত ছোট্ট কৃষ্ণকে নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয়। কৃষ্ণের পিছনে সেই শোভাযাত্রায় ছড়ি হাতে হাটতে থাকেন গোপিনীরা। সারাবছর কানহা গোপিনীদের অনেক কষ্ট দিয়েছে। আজ হোলির এই উতসবে গোপিনীদের সব কষ্টের শোধবোধের পালা। শোভাযাত্রার শেষে গোকুলের পুরুষরা অপেক্ষা করে।  কৃষ্ণকে যেমন গোপিনীরা ছড়ি দিয়ে মার দেয়, তেমনি গোকুলের গোপিনীসাজে সজ্জিতা মহিলারা,  পুরুষদের কৃষ্ণ ভেবে ছড়ি দিয়ে আঘাত করে। সেই আঘাত কিন্তু মোটেই এতটুকু কষ্ট দেয়না। বরং গোকুলের পুরুষরা গোপিনীদের হাতের ছড়ির স্পর্শ পেলে নিজেদের ধন্য মনে করে। এই হোলিউৎসবকে ছড়িমার হোলি বলা হয়।।

নন্দগাও যাওয়ার আগে গোকুল ছেড়ে কৃষ্ণ চলে এসেছিলেন বৃনদাবনে। রাধা কৃষ্ণের পবিত্র লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবনে মূলত দুই বার হোলি উতসব পালন হয়। দোল পূর্ণিমার আগের একাদশীর দিন বৃনদাবনের বাকে বিহারী মন্দিরে ফাগের বদলে ফুল দিয়ে হোলি খেলায় মেতে ওঠে মানুষ। ফাল্গুন শুক্লা একাদশীর দিন বিকাল ৪ টা থেকে ১৫-২০ মিনিটের জন্য এই ফুলের হোলি উতসব পালন হয়।  

বৃনদাবনের মূল হোলি উতসবটি পালন করা হয় বাকে বিহারী মন্দিরে দোল পূর্ণিমার আগের দিন। মমন্দিরের ভিতর বাইরে ভিড় জমায় লক্ষ লক্ষ মানুষ। বাকে বিহারীর সাথে সেইদিন রঙ খেলার সুযোগ পায় সকল ভক্ত। রংবেরঙের ফাগ আবীরে এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি হয় সমগ্র মন্দির চত্তরে।  

বৃনদাবনের কাছেই মথুরা। যমুনার এক তীরে গোকুল, অপর তীরে মথুরার রাজা কংসের কারাগারে জন্ম নেন শ্রীকৃষ্ণ। মথুরার হোলিখেলার মূল আকর্ষণ হল দ্বারকাধীশ মন্দিরের হোলি। একাদশী থেকেই ব্রজভূমে হোলি উতসব শুরু হলেও মথুরাতে দ্বারকাধীশ মন্দিরের মূল হোলি উতসবটি পালিত হয় দোল পূর্ণিমার আগের দিন এবং হোলির দিন। 

ব্রজধামের শেষ হোলিখেলা পালন হয় মথুরা থেকে ৩০ কিমি দূরে বলদেও তে দাউজী মন্দিরে। শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরামের মন্দির দাউজী মন্দিরে দোল পূর্ণিমার পরের দিন এক মজার হোলিখেলা পালন করা হয়। একে দাউজী কা হুরাঙ্গা বলা হয়ে থাকে। হোলি উতসবে শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখারা রাধা সহ অন্যান্য গোপিনীদের নানা ভাবে উত্যক্ত করতে থাকে। রেগে গিয়ে গোপিনীর দল শ্রীকৃষ্ণ ও তার বন্ধুদের তাড়া করে এবং যাকেই সামনে পায়, তার পোষাক ছিড়ে দেয়৷ এই হুরাঙ্গা নামক হোলি খেলাটি প্রায় ৫০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। 

Comments

Popular Stories on this blog

Brahma & Saraswati : Relation Explained! ব্রহ্মা-সরস্বতীঃ কেন পিতা কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন?

ভারতীয় পুরাণে রয়েছে মানব বিবর্তনের কাহিনী