গ্রীক মিথলজি গল্প: পার্সিফোনি এবং হেডেস
গ্রীক পুরাণের আর একটি বিখ্যাত কাহিনী হল পার্সেফোনি এবং হেডেস-এর গল্প। গ্রীকদের দেবতাদের রাজা ছিলেন জিউস। জিউস-এর স্ত্রী ডিমিটার ছিলেন প্রকৃতি, কৃষিকাজ এর দেবী। তাদের কন্যা ছিলেন পারসেফোনি। পারসেফোনি ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। তার রূপ মুগ্ধ ছিলেন অনেক দেবতারা। জিউসের ভাই, পাতালের রাজা হেডেস ছিলেন তাদেরই একজন। হেডেস পারসেফোনি'কে বিবাহ করার স্বপ্ন দেখতেন। সে প্রস্তাব তিনি দিয়েছিলেন জিউস এবং ডিমিটার'কে। জিউস রাজি থাকলেও ডিমিটার এই প্রস্তাব মেনে নেননি। পাতাললোকের দেবতার স্ত্রী! সেখানে তো শুধু মৃত আত্মার বাস! নিজের মেয়েকে কি এমন নরকে পাঠানো যায়!
ডিমিটার হুমকি দিলেন, হেডেস যদি তার মেয়ের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তার ফল হবে ভয়ংকর। মা ডিমিটার রাজি না হলেও জিউসের সায় পেয়ে মনে বল পেলেন হেডেস।
একদিন, পার্সেফোনি ফুলের বাগানে খেলা করছিলেন। মায়ের সৃষ্টি সুন্দর প্রকৃতির মধ্যে সে যেন মায়ের স্নেহের উষ্ণতা অনুভব করে। এমন সময় পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠল। এক বিশাল ফাটলে ভাগ হল ধরিত্রী। সেই গহ্বর থেকে বিশালদেহী চারটি ঘোড়ায় টানা এক রথ বেরয়ে এল। সেই রথ থেকে নেমে এলেন হেডেস। পার্সেফোনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, হেডেস তাকে টেনে তুলল ঘোড়ার গাড়িতে। তারপর সেই রথ ছুটিয়ে নিমেষে অদৃশ্য হল পাতালের গহ্বরে। এই ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন সূর্যদেবতা হেলিওস। কিন্তু কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়ে তিনি মুখ বন্ধ রাখলেন।
ওদিকে মেয়েকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন মা ডিমিটার। এমন সময়, যাদুবিদ্যা ও রাত্রের দেবী হেকেটি, ডিমিটারকে জানালেন, পার্সেফোনি'র ব্যাপারে সব তথ্য দিতে পারেন হেলিওস। ডিমিটার হেলিওসকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে প্রত্যক্ষদর্শী হেলিওস যা দেখেছেন, সবকিছু জানালেন ডিমিটারকে। হেডেস-এর কুকীর্তি জেনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন ডিমিটার। মেয়েকে হারানোর দুঃখে ডিমিটার এতটাই ভারাক্রান্ত হলেন যে, সমগ্র পৃথিবী তার কৃপা থেকে বঞ্চিত হল। কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে গেল, গাছপালা, ফসল, ফলমূল, শষ্য সবকিছু নষ্ট হয়ে গেল। চারিদিক প্রবল ঠান্ডায় তুষারাচ্ছন্ন হল।সমগ্র মনুষ্য সমাজে নেমে এল এক মহাপ্রলয়। এসব দেখে দেবতারা আতঙ্কিত হলেন। দেবতাদের অনুরোধে জিউস, ডিমিটার এবং হেডিস'কে ডেকে পাঠালেন দুজনের মধ্যে একটা সমঝোতা করার জন্য। অনেক বাকবিতন্ডার পর সিদ্ধান্ত হল, যদি পার্সিফোনি স্বেচ্ছায় মায়ের কাছে ফিরে আসতে চায়, তাহলে হেডেস বাধা দেবেন না। আর যদি সে পাতাললোকে থাকতে চায়, তাহলে ডিমিটার সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য থাকবেন।
পাতাললোকে ফিরে গিয়ে হেডেস একটা চক্রান্ত করলেন। বাবা-মায়ের শোকে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে পার্সিফোনি শুধু কান্নাকাটি করেছেন এই ক'দিন। হেডেস তাকে একটা ডালিম খেতে দিল। ক্ষিদের চোটে ছয়টি দানা মুখে দিল পার্সিফোনি। পাতাললোকের কোনো খাবার কেউ যদি একবার মুখে দেয়, সে আর পাতাললোক ছেড়ে আসতে চায় না। আর পাতাললোকের খাদ্য স্পর্শ করলে দেবতারাও তাকে আর গ্রহণ করেন না।
এরপর হেডেস পার্সিফোনিকে নিয়ে এল জিউসের দরবারে। সেখানে অন্যান্য দেবতাদের উপস্থিতিতে জিউস পার্সিফোনিকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে ডিমিটারের কাছে ফিরতে চান কি না। পাতাললোকের খাবার খেয়ে শাপগ্রস্ত পার্সিফোনি মায়ের কাছে ফিরতে অস্বীকার করল।
মেয়েকে ফিরে না পেয়ে ডিমিটার আরো ভয়ংকর হয়ে উঠলেন। ধরিত্রীর বুক থেকে প্রকৃতির সবুজতা মলিন হতে লাগল। খাদ্যাভাবে মানবসভ্যতা ধ্বংস হতে বসল। বাধ্য হয়ে জিউস সিদ্ধান্ত নিলেন, যেহেতু পার্সিফোনি ছয়টি ডালিমের দানা খেয়েছে, তাই ছয় মাস সে থাকবে পাতাললোকে স্বামী হেডেসের কাছে। বাকী ছয় মাস সে থাকবে মা ডিমিটারের কাছে। এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন ডিমিটার এবং হেডেস। সেই যাত্রায় রক্ষা পেল মানব সভ্যতা। মাসের যে ছয় মাস, পার্সিফোনি তার মায়ের কাছে থাকে, সেই সময় ডিমিটারের আশীর্বাদে ধরনী শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে। সেই ছয় মাস বসন্ত এবং গ্রীষ্মকাল থাকে। আর যে ছয় মাস পার্সিফোনি থাকে স্বামী হেডেসের কাছে, সেই ছয় মাস ডিমিটার মেয়ের শোকে কাঁদতে থাকে। এই ছয় মাস হেমন্ত এবং শীত কাল থাকে। প্রবল ঠান্ডায় তুষারাচ্ছন্ন হয় পৃথিবী। স্বামী হেডেসের আশীর্বাদে পার্সিফোনি হলেন পাতাললোকের রাণী আর মায়ের আশীর্বাদে তিনি হলেন শষ্যের দেবী।
Comments
Post a Comment